মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা এবং মেথি খাওয়ার নিয়ম
মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা – মেথি হলো একটি ভেষজ মৌসুমী উদ্ভিদ। মেথি সাধারণত মসলা, খাবার ও পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মেথি আমরা সকলেই চিনি। মেথি গাছ আমরা সাধারনত শাক হিসেবে খায় এবং তার বীজকে আমরা মসলা হিসেবে রান্না করতে ব্যবহার করি। গ্রাম বাংলার একটি প্রিয় খাবার হলো মেথি শাক। এটির স্বাদ সাধারণত তিতা হয়ে থাকে।
মেথির কথা মনে পড়লেই প্রচুর সুস্বাদু খাবারের কথা মনে পড়ে যায়। রান্না বান্না থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে আমরা মেথি ব্যবহার করে থাকি। পাচফোরন মসলার মধ্যে মেথি একটি অন্যতম উপাদান। দক্ষিণ ইউরোপ এবং এশিয়ার দেশগুলোতে মেথি চাষ বেশি হয়। মেথির বীজগুলি ছোট ছোট এবং এটি সোনালী রংয়ের দেখতে হয়। মেথির বীজ কবিরাজি , আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই আজ আমরা আপনাদের সামনে মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা এবং মেথি খাওয়ার নিয়মাবলী গুলি তুলে ধরব।
মেথি আসলে কি?
মেথি হচ্ছে একটি মৌসুমী ভেষজ উদ্ভিদ। গ্রামগঞ্জে এটিকে ছোট অবস্থায় শাক হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়। মেথি কে ইংরেজিতে বলা হয় Fenugreek এবং এটির বিজ্ঞানসম্মত নাম হল Trigonella foenum-graecum.
মেথিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিগুণ। শরীরের পুষ্টিগুণ কমে গেলে মেথি শাক খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন রোগ নিরাময় করতেও সক্ষম মেথি। তাহলে আসুন এক নজরে দেখে নিই মেথির পুষ্টিগুণ গুলি।
মেথির পুষ্টিগুণ ও পরিমান
* এক চামচ মেথির বীজে যে পরিমান পুষ্টি গুণ রয়েছে তা নিম্নে তালিকাভুক্ত করা হলো-
প্রোটিন | ২৩ গ্রাম |
সোডিয়াম | ৬৭ মিলিগ্রাম |
ক্যালসিয়াম | ১৭৬ মিলিগ্রাম |
পটাসিয়াম | ৭৭০ মিলিগ্রাম |
থিয়ামিন | ০. ৩২২ মিলিগ্রাম |
ফ্যাট | ৬.৪১ গ্রাম |
তামা | ১. ১১০ মিলিগ্রাম |
লোহা | ৩৩.৫৩ মিলিগ্রাম |
জিঙ্ক | ২. ৫০ মিলিগ্রাম |
ম্যাঙ্গানিজ | ১.২২৮ মিলিগ্রাম |
ভিটামিন এ | ৬০ IU |
ভিটামিন সি | ৩ মিলিগ্রাম |
রাইবোফ্লাভিন | ০. ৩৬৬ মিলিগ্রাম |
পাইরিডক্সিন | ০. ৬০০ মিলিগ্রাম |
নিয়াসিন | ১. ৬৪০ মিলিগ্রাম |
কার্বোহাইড্রেট | ৫৮. ৩৫ গ্রাম |
শক্তি | ৩২৩ কিলোক্যালোরি |
ফাইবার | ২৪.৬ গ্রাম |
ম্যাগনেসিয়াম | ১৯১ মিলিগ্রাম |
ফসফরাস | ২৯৬ মিলিগ্রাম |
মেথির উপকারিতা
মেথির কোনো কোন প্রকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই তা বলাই চলে। মেথি আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি উপাদান। এটি শুধু রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয় না বরং এটি বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসা তেও ব্যবহার করা হয়। আসুন এক নজরে মেথির উপকারিতা গুলি দেখে নিন –
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মেথি
প্রতিনিয়ত মেথি সেবন করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। মেথির বীজে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং বিভিন্ন রকম উপকারী উপাদান রয়েছে যা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও মেথি হজম শক্তি বৃদ্ধি করার পাশাপাশি শরীরের কার্বোহাইড্রেট এবং সুগার শোষণ করার ক্ষমতা রাখে। প্রতিনিয়ত মেথি সেবন করলে শরীরের ইনসুলিন নিঃসরণ এর মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বাতের ব্যথা কমাতে মেথি
বছর চল্লিশের ঊর্ধ্বে যে সকল ব্যক্তিরা রয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষেরই নানা রকম ব্যথা বা বাতের ব্যথা রয়েছে। এই তীব্র ব্যথা, এবং বেদনা থেকে মুক্তি দিতে মেথি খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
কোলেস্টেরল কমাতে মেথি
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে আনতে মেথি এক অন্যতম ভূমিকা পালন করে। মেথি যে শুধুমাত্র রক্তে থাকা কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে তা নয়, আপনার শরীরে থাকা কোলেস্ট্রল ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আনতেও সক্ষম মেথি। মেথি শরীরের লিপোপ্রোটিন বা ব্যাড প্রোটিন কমাতে সাহায্য করে। স্টেরিওডাল নামক একটি উপাদান মেথির মধ্যে রয়েছে, যেটি কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করতে বাধা দেয় এবং এটি কলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও মেথির বীজ লিভার থেকে উৎপন্ন তরলের শ্বসনের হার কমাতে সক্ষম।
হার্টের সুরক্ষার জন্য মেথি
হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য মেথির উপকারিতা অতুলনীয়। মানব শরীর থেকে অ্যাসিডের পরিমাণ খুব দ্রুত কমাতে সাহায্য করে মেথি। প্রতিদিন রাতের বেলায় জলের মধ্যে মেথির বীজ ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে মেথির বীজ ভেজানো জল পান করলে হার্টের ব্যথা বা বুক ব্যাথার মত সমস্যা থেকে সমাধান পাওয়া যায়। হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য মেথির মতন ভেষজ উপাদান পাওয়া খুব কঠিন।
হজম বৃদ্ধিতে মেথির উপকারিতা
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মেথি বীজ ভেজানো জল খালি পেটে খেলে পরে হজমের সমস্যা দূর হয়। মেথির বীজে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং অন্যান্য উপকারী উপাদান রয়েছে যা হজম বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
বুকের দুধ উৎপাদনে মেথির উপকারিতা
মেথিতে ডায়োসজেনিন নামক এক পদার্থ রয়েছে যা বুকের দুধ উৎপাদনে সাহায্য করে। মেথি তে উপস্থিত ভিটামিন এবং মিনারেল মায়ের দুধের পুষ্টি গুণ বাড়িয়ে তোলে। তাই স্তনদানকারী মহিলাদের ডাক্তারি পরামর্শ নিয়ে মেথি খাওয়া প্রয়োজন।
ক্যান্সার প্রতিরোধে মেথি
ক্যান্সারের মতো মারণ রোগ থেকেও জীবন বাঁচাতে সক্ষম মেথি। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতিনিয়ত মেথি সেবন করলে ক্যান্সার হবার আশঙ্কা কম। মেথিতে ট্রাইগ্লিসারাইড নামক একটি উপাদান রয়েছে যা ব্রেস্ট ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষগুলিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলে। রক্তে ভেসে থাকা টক্সিক উপাদানগুলিকে শরীর থেকে বের করতে সাহায্য করে । যার ফলে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা খুব কম। রক্তে যদি টক্সিক উপাদান এর মাত্রা বাড়তে থাকে, তাহলে শরীরের ভেতর ক্যান্সার সেলের জন্ম বৃদ্ধি পেতে থাকে। ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে রক্ষা পেতে মহিলাদেরকে রান্নায় মেথি ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা।
ওজন কমাতে মেথির উপকারিতা
ওজন কমানোর জন্য মেথির ভূমিকা অপরিসীম। মেথির বীজে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, তামা, ভিটামিন বি ৬, প্রোটিন, ফাইবার এছাড়াও নানান খনিজ পদার্থ। মেথির বীজের মধ্যে এক ধরনের ফাইবার থাকে যা গ্লাকটো মান্নান নামে পরিচিত। এটি আমাদের শরীরে বেশি খিদে লাগতে দেয় না। আর স্বাভাবিকভাবেই খাওয়ার পরিমাণ প্রশমন হলে শরীরের ওজন হ্রাস পাবে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে মেথির উপকারিতা
মেথির বীজে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম এবং ফাইবার উপস্থিতির কারণে রক্তচাপ হ্রাসের জন্য মেথি একটি কার্যকরী উপাদান। দুই চামচ মেথি দু মিনিটের জন্য গরম জলে ফুটিয়ে তারপর সেটিকে ছেকে নিয়ে বীজ গুলিকে একটি ব্লেন্ডারের ভিতরে দিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিন। এই পেস্ট আপনি যদি সকালে খালি পেটে খেতে পারেন তাহলে মাত্র ১-২ মাসের মধ্যেই এর উপকারিতা লক্ষ্য করতে পারবেন।
পিরিয়ডস এর ব্যথা কমাতে মেথির উপকারিতা
পিরিয়ড বা মাসিক হল প্রত্যেকটি মেয়ের জীবনে এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়। তবেই প্রত্যেকটি মেয়ে এই পিরিয়ডের সময় ব্যাথা অনুভব করে থাকেন। মাসের ওই দিনগুলিতে যদি মেথি দিয়ে বানানো চা বা দিনে তিনবার মেথি গুঁড়া খান তাহলে এই ব্যথা উপশম হবে।
কিডনির কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে মেথির উপকারিতা
২০০৭ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী জানা গিয়েছে, ক্যালসিয়াম অক্সালেট জাতীয় কিডনির পাথর প্রতিরোধ করতে সক্ষম মেথি। নিয়মিত মেথি খাওয়ার ফলে কিডনির মধ্যে কম ক্যালসিফিকেশন তৈরি হয়। মেথির রস তৈরি করে পান করলে কিডনি পরিষ্কার থাকে এবং মূত্রথলি সুস্থ থাকে।
ত্বকের জন্য মেথির উপকারিতা
ত্বক এবং রূপচর্চাতেও মেথি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মেথির বীজে থাকা এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল পদার্থ ত্বকের গভীরে গিয়ে ব্রণের দাগ থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম। এছাড়াও মেথির বীজে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা ত্বকের মৃত কোষ গুলোকে তুলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং ত্বক উজ্জ্বল দেখায়। আসুন কিভাবে মেথির ব্যবহার কি ভাবে করবেন সেগুলো জেনে নেওয়া যাক।
ব্রোনো নির্মূল করতে মেথির ব্যবহার
মেথির বীজ পরিমাণমত জলের মধ্য দিয়ে বেশ কিছুক্ষন ধরে ফুটিয়ে নিতে হবে। এরপর ওই জল ঠান্ডা হয়ে গেলে বীজগুলো আলাদা করে জলটা মুখে লাগাতে হবে।
বার্ধক্য প্রতিরোধে মেথির ব্যবহার
এক চামচ মেথির গুড়ার সঙ্গে পরিমাণমতো জল এবং একটু দই মিশিয়ে সম্পূর্ণ মুখে লাগিয়ে রাখতে হবে। এটি ১০ থেকে ২০ মিনিট মুখে লাগিয়ে রাখার পর ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে।
চুলের জন্য মেথির উপকারিতা
চুল পড়া রোধ করতে মেথির উপকারিতা
মেথিতে ভিটামিন এবং ভিটামিন সি রয়েছে যা চুল পড়া রোধ করতে সাহায্য করে। লিথিসিন নামক একটি পদার্থ আমাদের চুলে থাকে যেটি চুল পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাই। মেথি দিয়ে বানানো পেস্ট চুলে ব্যবহার করলে নতুন করে লিথিসিন তৈরি হয়। এতে চুল মজবুত করে এবং চুলের সমস্যা সমাধান করে।
এক চামচ মেথি গুঁড়া পরিমাণমতো জলের সঙ্গে মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন এবং সেই পেস্টটি চুলে ভালো করে লাগিয়ে নিন। এটা লাগানোর পর ২০ মিনিট মতো পর ভালো করে চুল ধুয়ে নিন। একমাস মতো এটি ব্যবহার করলে উপকারিতা লক্ষ্য করতে পারবেন।
চুলের অকালপক্বতা দূরীকরণে মেথির উপকার
বয়স বেশি না কিন্তু চুল পেকে যাওয়ার সমস্যা যাদের রয়েছে তাদের জন্য মেথি একটি অন্যতম উপাদান। এক চামচ মেথি গুঁড়োর সঙ্গে আমলকি গুঁড়ো নিতে হবে পরিমাণমতো জল দিয়ে এটি মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর যে পেস্টটি তৈরি হবে সেটি ভালো করে চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত মেখে নিতে হবে। ২০ মিনিট মতন রাখার পর ভালো করে মাথা ধুয়ে নিতে হবে। কয়েক দিন ব্যবহার করলেই এর উপকারিতা লক্ষ্য করতে পারবেন।
খুশকি রোধে মেথি
খুশকি রোধে মেথির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাফ কাপ মেথির গুঁড়োর সঙ্গে পরিমানমতো জল এবং লেবুর রস মিশিয়ে একটি পেস্ট বানিয়ে ফেলতে হবে। সেটি চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ভাল করে লাগিয়ে রাখতে হবে। কুড়ি মিনিট মত রাখার পর এটি ভালো করে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। মাঝেমধ্যেই এটা করলে খুশকি থেকে মিলবে রেহায়।
মেথি খাওয়ার নিয়ম
মেথি হল সুষমা ভেষজ উপাদানের মধ্যে একটি অন্যতম উপাদান। এটি খেলে শরীরে সব দিক থেকে উপকার হয়। মেথি আপনি যেকোন ভাবে খেতে পারেন। মেথি গাছ যখন ছোট থাকে তখন এটিকে শাক হিসেবেও রান্না করে খেতে পারেন। আবার মেথি বীজ জলে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকাল বেলায় খালি পেটে সেই জল পান করতে পারেন। মেথিতে প্রচুর পরিমাণে আয়ুর্বেদিক গুনাগুণ রয়েছে।
মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা এবং মেথি খাওয়ার নিয়ম আজ আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এই নিবন্ধটি পড়ে আপনি যদি উপকৃত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার প্রিয়জনদের কাছে এটি শেয়ার করবেন। পাশাপাশি আপনার যদি নিজস্ব কোনো মতামত জানানোর থাকে contact-us পেজে গিয়ে সেটি জানাতে পারেন।