বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উক্তি – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন ব্রিটিশ বাঙালি উপন্যাসিক। তিনি ২৮ শে জুন ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠাল পাড়া গ্রামে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বয়স যখন পাঁচ বছর, সেই সময় পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে হাতেখড়ি হয় তার। বাল্য বয়সেই তার অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কণিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিলেন।” যদিও গ্রামের পাঠশালায় তিনি কোনদিনও যাননি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শিক্ষার জন্য তার গৃহ শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন পাঠশালার গুরু মহাশয় রামপ্রান সরকার।
কর্মসূত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের ছিলেন ব্রিটিশ রাজের কর্মকর্তা। বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র বঙ্গদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের সাহিত্য সম্রাট হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত এবং তাকে বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয় থাকে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার করতেন কমলাকান্ত নামটি। ১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আনন্দমঠ উপন্যাসের বন্দেমাতরম কবিতাটির জন্য ১৯৩৭ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
ব্রিটিশ বাঙালি উপন্যাসিক, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উক্তি নিয়ে আজ আমরা আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আসুন এক নজরে দেখে নিন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উক্তি গুলি –
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উক্তি ও বাণী সমূহ
১
“মীরজাফর গুলি খায় ও ঘুমায়। ইংরেজ টাকা আদায় করে ও ডেসপাচ লেখে। বাঙ্গালি কাঁদে আর উৎসন্ন যায়।”
২
“একজন পুরুষ প্রকাশ্যে সেই সব কাজ করিয়া রোশনাই করিয়া জুড়ি হাকাইয়া রাত্রিশেষে পত্নীকে চরণরেণু স্পর্শ করাইয়া আসেন, পত্নী পুলকিত হয়েন। ”
৩
“সাহিত্যের আলোচনায় সুখ আছে বটে, কিন্তু যে সুখ তোমার উদ্দেশ্য এবং প্রাপ্য হওয়া উচিত, সাহিত্যের সুখ তাহার ক্ষুদ্রাংশ মাত্র।”
৪
“ স্ত্রীলোকদিগের উপর যেমন কঠিন শাসন, পুরুষের উপর তেমন কিছু নেই।
৫
“পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’”।
৬
“মরিলে যদি রণজয় হইত,তবে মরিতাম। বৃথা মৃত্যু বীরের ধর্ম নহে”
৭
“যাকে ভালবাস তাকে চোখের আড়াল করোনা।”
৮
“আত্মোপকারীকে বনবাসে বিসর্জন করা যাহাদিগের প্রকৃতি, তাহারা চিরকাল আত্মোপকারীকে বনবাসে দিবে – কিন্তু যতবার বনবাসিত করুক না কেন, পরের কাষ্ঠাহরণ করা যাহার স্বভাব, সে পুনর্বার পরের কাষ্ঠাহরণে যাইবে। তুমি অধম – তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন?”
৯
“কতকগুলি লোক আছে, এদেশের লোক তাহাদের বর্ণনার সময় বলে, “ইহারা কুকুর মারে, কিন্তু হাঁড়ি ফেলে না৷”
পাহাড় নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উক্তি
১০
“সে প্রফুল্লতা, সে সুখ ,আর নাই কেন ? সুখের সামগ্রী কি কমিয়াছে? অর্জন এবং ক্ষতি উভয়েই সংসারের নিয়ম। কিন্তু ক্ষতি অপেক্ষা অর্জন অধিক ,ইহাও নিয়ম। তুমি জীবনের পথ যতই অতিবাহিত করিবে ,ততই সুখদ সামগ্রী সঞ্চয় করিবে ।তবে বয়সে স্ফূর্ত্তি কমে কেন?”
১১
“স্ত্রীলোকদিগের উপর যেমন কঠিন শাসন, পুরুষের উপর তেমন কিছু নেই। কথায় কিছু হয় না, ভ্রষ্ট পুরুষের কোন সামাজিক দণ্ড নেই। একজন স্ত্রী সতীত্ব সম্বন্ধে কোন দোষ করিলে সে আর মুখ দেখাইতে পারে না। হয়তো আত্মীয় স্বজন তাকে বিষ প্রদান করেন, আর একজন পুরুষ প্রকাশ্যে সেই সব কাজ করিয়া রোশনাই করিয়া জুড়ি হাকাইয়া রাত্রিশেষে পত্নীকে চরণরেণু স্পর্শ করাইয়া আসেন, পত্নী পুলকিত হয়েন।”
১২
“যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন, তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।”
১৩
“যে কণ্ঠ হইতে কাতরের জন্য কাতরোক্তি নিঃসৃত না হইল, সে কণ্ঠ রুদ্ধ হউক। যে লেখনি আর্তের উপকারার্থে না-লিখিল, সে লেখনি নিষ্ফলা হউক।”
১৪
“গ্রন্থ পাঠ করিয়া পাঠক যে সুখ লাভ বা জ্ঞান লাভ করিবেন, তাহা অধিকতর স্পষ্টীকৃত বা তাহার বৃদ্ধি করা, গ্রন্থকার যেখানে ভ্রান্ত হইয়াছেন সেখানে ভ্রম সংশোধন করা, যে গ্রন্থে সাধারণের অনিষ্ট হইতে পারে সেই গ্রন্থের অনিষ্টকারিতা সাধারণের নিকট প্রতীয়মান করা—এইগুলি সমালোচনার উদ্দেশ্য।”
১৫
“যাহাতে সাধারণের উন্নতি নাই, তাহাতে কাহারই উন্নতি সিদ্ধ হইতে পারে না।…অনেকে বিবেচনা করেন যে, বালকের পাঠোপযোগী অতি সরল কথা ভিন্ন কিছুই সাধারণের বোধগম্য বা পাঠ্য হয় না। এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া যাঁহারা লিখিতে প্রবৃত্ত হয়েন, তাহাদিগের রচনা কেহই পড়ে না। যাহা সুশিক্ষিত ব্যক্তির পাঠোপযোগী নহে, তাহা কেহই পড়িবে না, যাহা উত্তম তাহা সকলেই পড়িতে চাহে, যে না-বুঝিতে পারে, সে বুঝিতে যত্ন করে।”
১৬
“আমরা সকলেই স্বার্থাভিলাষী। লেখক মাত্রই যশের অভিলাষী। যশ, সুশিক্ষিতের মুখে। অন্যে সদসত্ বিচারক্ষম নহে। তাহাদের নিকট যশ হইলে তাহাতে রচনার পরিশ্রমের সার্থকতা বোধ হয় না। সুশিক্ষিতে না-পড়িলে সুশিক্ষিত ব্যক্তি লিখিবে না।”
১৭
“সাহিত্য ধর্ম ছাড়া নহে। কেননা, সাহিত্য সত্যমূলক। যাহা সত্য, তাহা ধর্ম। যদি এমন কুসাহিত্য থাকে যে তাহা অসত্যমূলক ও অধর্মময়, তবে তাহার পাঠে দুরাত্মা বা বিকৃতরুচি পাঠক ভিন্ন কেহ সুখী হয় না।”
১৮
“এক একখানি প্রস্তর পৃথক করিয়া দেখিলে তাজমহলের গৌরব বুঝিতে পারা যায় না। এক একটি বৃক্ষ পৃথক পৃথক করিয়া দেখিলে উদ্যানের শোভা অনুভব করা যায় না। এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বর্ণনা করিয়া মনুষ্যমূর্তির অনির্বচনীয় শোভা বর্ণনা করা যায় না। কোটি কলস জলের আলোচনায় সাগর-মাহাত্ম্য অনুভব করা যায় না। সেইরূপ কাব্যগ্রন্থের।”
১৯
“কাব্যগ্রন্থ মনুষ্যজীবনের কঠিন সমস্যা সকলের ব্যাখ্যা মাত্র, যিনি একথা না বুঝিয়া, একথা বিস্মৃত হইয়া, কেবল গল্পের অনুরোধে উপন্যাস পাঠে নিযুক্ত হয়েন, তিনি উপন্যাস পাঠ না করিলেই বাধিত হই।”
২০
“মনুষ্যের সুখ মনুষ্যত্বে, এই মনুষ্যত্ব সকল বৃত্তিগুলির উপযুক্ত স্ফূর্তি, পরিণতি ও সামঞ্জস্যের সাপেক্ষ। মনুষ্যের সমুদয় শক্তিগুলিকে চারি শ্রেণীতে বিভক্ত করা গেল: ১. শারীরিকী, ২. জ্ঞানার্জনী, ৩. কার্যকারিনী, ৪. চিত্তরঞ্জিনী। এই চতুর্বিদ বৃত্তির উপযুক্ত স্ফূর্তি, পরিণতি ও সামঞ্জস্যই মনুষ্যত্ব।”
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উক্তি
২১
“ওপারে যে যন্ত্রণার কথা শুনিতে পাও, সে আমরা এই পার হইতে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাই। আমাদের এ জন্মের সঞ্চিত পাপগুলি আমরা গাঁটরি বাঁধিয়া, বৈতরিণীর সেই ক্ষেয়ারীর ক্ষেয়ায় বোঝাই দিয়া, বিনা কড়িতে পার করিয়া লইয়া যাই। পরে যমালয়ে গিয়া গাঁটরি খুলিয়া ধীরে সুস্থে সেই ঐশ্বর্য্য একা একা ভোগ করি।”
২২
“যে কখনো রোদন করে নাই, সে মনুষ্য মধ্যে অধম। তাহাকে কখনও বিশ্বাস করিও না। নিশ্চিত জানিও সে পৃথিবীর সুখ কখনো ভোগ করে নাই। এর সুখও তাহার সহ্য হয় না।”
২৩
“পাহাড় যত নিকট দেখায়, তত নিকট নয়।”
২৪
“জ্ঞানে মনুষ্য মাত্রেরই তুল্যাধিকার। যদি সে সর্বজনের প্রাপ্য ধনকে তুমি এমত দুরূহ ভাষায় নিবদ্ধ রাখ যে, কেবল যে কয়জন পরিশ্রম করিয়া সেই ভাষা শিখিয়াছে তাহারা ভিন্ন আর কেহ তাহা পাইতে পারিবে না, তবে তুমি অধিকাংশ মানুষকে তাহাদিগের স্বত্ব হইতে বঞ্চিত করিলে। তুমি সেখানে বঞ্চক মাত্র।”
২৫
“তুমি সাহিত্য পাঠে অনুরক্ত এবং তাহাতে আনন্দ লাভ কর, তাহার কারণ এই যে, যে সকল বৃত্তির অনুশীলন করিলে সাহিত্যের মর্ম গ্রহণ করা যায়, তুমি চিরকাল সেই সকল বৃত্তির অনুশীলন করিয়াছ, কাজেই তাহাতে আনন্দ লাভ কর। যে সকল বৃত্তির অনুশীলনে ধর্মের মর্ম গ্রহণ করা যায়, তুমি সেগুলির অনুশীলন কর নাই, এজন্য তাহার আলোচনায় তুমি আনন্দ লাভ কর না।”
২৬
“সকল বিষয়েই প্রকৃত অবস্থার অপেক্ষা উত্কৃষ্ট আমরা কামনা করি। সেই উত্কর্ষের আদর্শস্থল আমাদের হূদয়ে অস্ফুট রকমে থাকে। সেই আদর্শ এবং সেই কামনা কবির সামগ্রী। যিনি তাহা হূদয়ঙ্গম করিয়াছেন, তাহাকে গঠন দিয়া শরীরী করিয়া আমাদের হূদয়গ্রাহী করিয়াছেন, সচরাচর তাঁহাকেই আমরা কবি বলি।”
২৭
“টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে এবং টাকাও পায় লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সে দিন হয় নাই। এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে লোকরঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লোকরঞ্জন করিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে।”
২৮
“কুকাব্যও আছে। সে বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকা উচিত। যাহারা কুকাব্য প্রণয়ন করিয়া পরের চিত্ত কলুষিত করিতে চেষ্টা করে, তাহারা তস্করদিগের ন্যায় মনুষ্যজাতির শত্রু এবং তাহাদিগকে তস্করাদির ন্যায় শারীরিক দণ্ডের দ্বারা দণ্ডিত করা উচিত।”
২৯
“সাহিত্যে যে সত্য ও যে ধর্ম, সমস্ত ধর্মের তাহা এক অংশ মাত্র। অতএব, কেবল সাহিত্য নহে, যে মহত্ত্বের অংশ এই সাহিত্য, সেই ধর্মই এইরূপ আলোচনীয় হওয়া উচিত। সাহিত্য ত্যাগ করিও না, কিন্তু সাহিত্যকে নিম্নে সোপান করিয়া ধর্মের মঞ্চে আরোহণ কর।”
৩০
“কাব্যের উদ্দেশ্যে নীতিজ্ঞান নহে; কিন্তু নীতিজ্ঞানের যে উদ্দেশ্য, কাব্যেরও সেই উদ্দেশ্য। কাব্যের গৌণ উদ্দেশ্য মনুষ্যের চিত্তোত্কর্ষ সাধন—চিত্তশুদ্ধি জনন। কবিরা জগতের শিক্ষাদাতা, কিন্তু নীতিব্যাখ্যার দ্বারা তাঁহারা শিক্ষা দেন না। কথাচ্ছলেও নীতিশিক্ষা দেন না। তাঁহারা সৌন্দর্যের চরমোত্কর্ষ সৃজনের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি বিধান করেন। এই সৌন্দর্যের চরমোত্কর্ষের সৃষ্টি কাব্যের মুখ্য উদ্দেশ্য।”
আমাদের শেষ কথা
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উক্তি ও বাণী গুলি সম্পূর্ণ পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই নিবন্ধটি আপনার ভালো লেগে থাকলে আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন এবং এরকম সুন্দর সুন্দর আরও পোস্ট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ fb.com/banglaprotibedon ফলো করুন।