মানব বন্দনা কবিতা -টির রচয়িতা হলেন অক্ষয় কুমার বড়াল। অক্ষয় কুমার বড়াল ছিলেন একজন সাহিত্যিক এবং একজন বাঙালি শ্রেষ্ঠ কবি। অক্ষয় কুমার বড়াল যখন হেয়ার স্কুলে পাঠরত ছিলেন তখন তিনি সুখ্যাত বিহারীলাল চক্রবর্তী কবিতার প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। বিহারীলাল চক্রবর্তী ছিলেন একজন বাংলা গীতি কবি। অক্ষয় কুমার বড়াল বিহারীলাল চক্রবর্তীর অনুপ্রেরণায় কবিতা লেখা শুরু করেন। অক্ষয় কুমার বড়াল একাধিক কাব্যগ্রন্থ এবং কবিতা রচনা করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম একটি কবিতা হল মানব বন্দনা।
মানব বন্দনা
– অক্ষয় কুমার বরাল
সেই আদি-যুগে যবে অসহায় নর
নেত্র মেলি ভবে,
চাহিয়া আকাশ পানে – কারে ডেকেছিল,
দেবে না মানবে?
কাতর আহ্বান সেই মেঘে মেঘে উঠি,
লুটি গ্রহে গ্রহে,
ফিরিয়া কি আসে নাই, না পেয়ে উত্তর,
ধরায় আগ্রহে?
সেই ক্ষুব্ধ অন্ধকারে, মরুৎ গর্জনে,
কার অন্বেষণ?
সে নহে বন্দনা-গীতি, ভয়ার্ত-ক্ষুধার্ত
খুঁজিছে স্বজন!
আরক্ত প্রভাত সূর্য উদিল যখন
ভেদিয়া তিমিরে,
ধরিত্রী অরণ্যে ভরা, কর্দমে পিচ্ছিল
সলিলে শিশিরে!
শাখায় ঝাপটি পাখা গরুড় চিৎকারে
কাণ্ডে সর্পকুল,
সম্মুখে শ্বাপদ-সংঘ বদন ব্যাদানি
আছাড়ে লাঙ্গুল;
দংশিছে দংশক গাত্রে, পদে সরীসৃপ,
শূন্যে শ্যেন উড়ে;-
কে তাহারে উদ্ধারিল? দেব না মানব –
প্রস্তরে লগুড়ে?
শীর্ণ অবসন্ন দেহ, গতিশক্তিহীন,
ক্ষুধায় অস্থির;
কে দিল তুলিয়া মুখে স্বাদু পক্বফল,
পত্রপুটে নীর?
কে দিল মুছায়ে অশ্রু? কে বুলাল কর
সর্বাঙ্গে আদরে?
কে নব পল্লবে দিল রচিয়া শয়ন
আপন গহ্বরে?
দিল করে পুষ্পগুচ্ছ, শিরে পুষ্পলতা,
অতিথি সৎকার!
নিশীথে বিচিত্র সুরে বিচিত্র ভাষায়
স্বপনসম্ভার!!
শৈশবে কাহা সাথে জলে স্থলে ভ্রমি
শিকার-সন্ধান?
কে শিখাল ধনুর্বেদ, বহিত্র চালনা,
চর্ম পরিধান?
অর্ধদগ্ধ মৃগমাংস কার সাথে বসি,
করিনু ভক্ষণ?
কাষ্ঠে কাষ্ঠে অগ্নি জ্বালি কার হস্ত ধরি
কুর্দন নর্তন?
কে শিখাল শিলাস্তূপে, অশ্বত্থের মূলে
করিতে প্রণাম?
কে শিখাল ঋতুভেদ, চন্দ্র-সূর্য মেঘে
দেব-দেবী নাম?
কৈশোরে কাহার সনে মৃত্তিকা কর্ষণে
হইনু বাহির?
মধ্যাহ্নে কে দিল পাত্রে শালি অন্ন ঢালি,
দধি-দুগ্ধ-ক্ষীর?
সায়াহ্নে কুটির দ্বারে কার কণ্ঠ সাথে
নিবিদ উচ্চারি?
কার আশীর্বাদ লয়ে অগ্নি সাক্ষী করি
হইনু সংসারী?
কে দিল ঔষধি রোগে ক্ষতে প্রলেপন –
স্নেহে অনুরাগে?
কার ছন্দে – সোম গন্ধে – ইন্দ্র অগ্নি বায়ু
দিল যজ্ঞ ভাগে?
যৌবনে সাহায্যে কার নগর পত্তন,
প্রাসাদ নির্মাণ?
কার ঋক্ সাম যজুঃ চরক সুশ্রুত,
সংহিতা পুরাণ?
কে গঠিল দুর্গ, সেতু, পরিখা, প্রণালী,
পথ, ঘাট, মাঠ?
কে আজ পৃথিবীরাজ – জলে স্থলে ব্যোমে
কার রাজ্যপাট?
পঞ্চভূত বশীভূত প্রকৃতি উন্নীত
কার জ্ঞানে বলে?
ভুঞ্জিতে কাহার রাজ্য – জন্মিলেন হরি
মথুরা কোশলে?
প্রবীণ সমাজ পদে, আজি প্রৌঢ় আমি
জুড়ি দুই কর,
নমি, হে বিবর্ত-বুদ্ধি! বিদ্যুৎ-মোহন,
বজ্রমুষ্টিধর!
চরণে ঝটিকাগতি- ছুটিছ উধাও
দলি নীহারিকা।
উদ্দীপ্ত তেজসনেত্র – হেরিছ নির্ভয়ে
সপ্তসূর্য শিখা।
গ্রহে গ্রহে আবর্তন – গভীর নিনাদ
শুনিছ শ্রবণে?
দোলে মহাকাল – কোলে অণু পরমাণু
বুঝিছ স্পর্শনে?
নমি, হে সার্থক কাম! স্বরূপ তোমার
নিত্য অভিনব!
মর দেহে নহ মর, অমর অধিক
স্থৈর্য ধৈর্য তব?
লয়ে সলাঙ্গুল দেহ, স্থূলবুদ্ধি তুমি
জন্মিলে জগতে!
শুষিলে সাগর শেষে, রসাইলে মরু
উড়ালে পর্বতে!
গড়িলে আপন মূর্তি – দেবতালাঞ্ছন
কালের পৃষ্ঠায়!
গড়িছ ভাঙিছ তর্কে, দর্শনে, বিজ্ঞান
আপন স্রষ্টায়।
নমি তোমা নরদেব! কী গর্বে গৌরবে
দাঁড়িয়েছ তুমি!
সর্বাঙ্গে প্রভাতরশ্মি, শিরে চূর্ণ মেঘ,
পদে শষ্পভূমি।
পশ্চাতে মন্দির-শ্রেণি, সুবর্ণ কলস,
ঝলসে কিরণে;
কলকণ্ঠ-সমুত্থিত নবীন উদগীথ
গগনে পবনে।
হৃদয়-স্পন্দন সনে ঘুরিছে জগৎ
চলিছে সময়;
ভ্রূভঙ্গে – ফিরিছ সঙ্গে – ক্রমব্যতিক্রম
উদয়-বিলয়।
নমি আমি প্রতিজনে, আদ্বিজ-চণ্ডাল,
প্রভু, ক্রীতদাস!
সিন্ধুমূলে জলবিন্দু, বিশ্বমূলে অণু;
সমগ্রে প্রকাশ!
নমি কৃষি-তন্তুজীবী, স্থপতি, তক্ষক,
কর্ম, চর্মকার!
অদ্রিতলে শিলাখণ্ড – দৃষ্টি অগোচরে,
বহ অদ্রি-ভার!
কত রাজ্য, কত রাজা গড়িছ নীরবে
হে পূজ্য, হে প্রিয়!
একত্বে বরেণ্য তুমি, শরণ্য এককে,-
আত্মার আত্মীয়।
আমাদের শেষ কথা
অক্ষয় কুমার বরালের মানব বন্দনা কবিতা টি সম্পূর্ণ পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই নিবন্ধটি আপনার ভালো লেগে থাকলে আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন এবং এরকম সুন্দর সুন্দর আরও পোস্ট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ fb.com/banglaprotibedon ফলো করুন।